Saturday, June 6, 2015

দাঁড়াও পথিক!

হে দ্রুতশীল পথিক!
একটু দাঁড়াও । তুমি যে পথে হাঁটছো, এই পথ কি ঠিক? যার পানে অন্ধের ন্যায় ছুটছো, সে লক্ষ্য কি ঠিক?
তুমি কি জানো, কিসের নেশায় কার পেছনে ছুটছো?
নিজেকে প্রশ্ন করেছো কখনো তুমি আসলে কী ও কেনো?
যদি আমার প্রশ্নে তোমার ভ্রুক্ষেপ না পড়ে অথবা মনে উৎসাহের সৃষ্টি না হয়, তবে "তুমি অন্ধ-মূক-বধির । তোমার অন্তরে স্রষ্টা মোহর মেরে দিয়েছেন (পূর্বোক্ত কোনো বিশেষ অবহেলার জন্য)।"

মানুষ সামাজিক জীব । কথাটা অনেক পুরোনো । তারপরেও বারবার বলতে হয় স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য । প্রথমে তোমার কথাই বলি । সমাজে তোমার গুরুত্ব কতটুকুন? তুমিইবা সমাজকে কী দিচ্ছো? কিছু একটা মাথায় আসছে হয়তো । তবে সেটা ধোঁয়াশা ।

আমার সাথে চলো ।দয়া করে প্রশ্ন করবে না কোথায় নিয়ে যাচ্ছি !
তবে দুশ্চিন্তার কারণও নেই । কারণ তোমাকে সশরীরে জোরপূর্বক কোথাও নিয়ে যাবো না ।

"শান্তি" নামের সমসাময়িক একটা দেশের কথা বলছি। এখানে সকল ধর্মের সকল শ্রেণির মানুষের বসবাস। ইদানীং লক্ষ্য করলাম এখানে সকলধরণের অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিদিনের পত্রিকায় গুম-খুন-ধর্ষণের চিত্র ! নিজের মেয়েকে বাবা করছে ধর্ষণ! মা তার সন্তানের লালসার স্বীকার ! ভাই ভাইয়ের হাতে হচ্ছে খুন। ছাত্রের হাতে মার খাচ্ছে শিক্ষক ! বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা শুধুই বাড়ছে । রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার সাধারণ মানুষেরা! ভারসাম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শ্রেণীবৈষম্যের অভাব নেই । কেউ না খেয়ে মরছে আর কেউ বিরাট প্রাসাদে নিদ্রায় দিন কাটাচ্ছে । তার সাথে বেড়ে চলেছে সকল ধরণের অবক্ষয় ।

চৌধুরী বাড়ির কাজের বেটি রহিমার বড় ছেলে ভালো রেজাল্ট নিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন, অনার্স-মাষ্টার্স করে চাকরির অভাবে বেকার । চাকরি নিতে ঘুষ লাগে । সেদিন রিক্সাচালক রমজান আলীর ছোট মেয়েটা স্কুল থেকে ফেরার পথে রক্তমাখা ছিন্নভিন্ন পরনের কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরলো । সন্ধ্যাবেলায় শুনলাম মেয়েটা নাকি মারা গেছে । আমাদের বাড়ির সামনে দিনমজুর কলিমদ্দিন একটা পর্ণকুটিরে হাঁপানি রোগে অনেকদিন ধরে ভুগছে । টাকার জন্য ভালো চিকিৎসা করতে পারেনি । বেচারাকে গতকাল গোরস্থানে রেখে এলাম । ও পাড়ার গিট্টুদের বাড়িতে গতকাল পুলিশ এসেছিলো। মাদকদ্রব্যের চোরাচালানের খবরটা কিভাবে জানি পুলিশের কানে গিয়েছিলো । মাংস-পোলা আর মানিব্যাগ ভর্তি করে পুলিশরা চলে গিয়েছে । গিট্টুদের কিচ্ছু হয়নি । আমি যে হাইস্কুলে পড়ি স্যারেরা ক্লাস করায় কৌশলে যাতে স্যারের কাছে বারোমাস প্রাইভেট পড়তে হয় । নাহিদ গতবার প্রাইভেট না পড়ায় স্যার ওকে ফেল করে দিয়েছে । কিছুদিন আগে আমি এইচএসসি পাস করলাম । কোচিং ছাড়া নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যায়না । আমার দরিদ্র পিতাকেও শেষ পর্যন্ত বড়লোকের ন্যায় কাড়িকাড়ি টাকা ব্যায় করতে হলো ঋণ করে । ভার্সিটিতে গিয়ে দেখি ওখানে রাজনীতি আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী শেখায়, দাবি আদায়ের নামে জ্বালাও পোড়াও হরতাল-পিকেটিং শেখায়। আমার বন্ধুর হাতে একটা ককটেল ছিলো । সে নিক্ষেপ করতে গিয়ে একটা বাচ্চার শরীরে পড়ে । পরদিন বাচ্চাটা বার্ণ ইউনিটে মারা যায় । এইতো কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের সামনে কয়েকটা ইজিবাইক ভাঙ্গলাম নিজের হাতে । তাদের দোষ আমাদের একজনের গায়ে হাত তুললো কেনো ! তাই সব ভেঙ্গে দিয়েছি ।
জানো পথিক, আমাদের সম্মানিত ভিসি স্যারকেও তালা মেরে রাখতে আমাদের কুন্ঠাবোধ হয় না । ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্ক আমরা একরকম ভুলেই গিয়েছি!
ঐদিন মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলাম । বারান্দায় রোগীরা ছটফট করছে । ডাক্তার ছাত্র ছাত্রী কেউ নেই । পরে শুনলাম তারা নাকি কয়েকদিন অবরোধ-বিক্ষোভ ডেকেছে । যতক্ষণ না সরকার তাদের দাবি দাওয়া না মেনে নিবে , এ অবরোধ-বিক্ষোভ চলবে । তাতে রোগীদের প্রাণ থাকুক আর যায় যাক !
নির্বাচনের আগের দিনে রায়পাড়ার হিন্দু বাড়িতে আগুণ লাগিয়ে দিলো উগ্রপন্থীরা । গেলো এসএসসি পরীক্ষায় নাকি প্রশ্নপত্র যত্রতত্রে পাওয়া গিয়েছে । দেখি গোবর গণেশটা আজকাল মেট্রিক পাসের মিষ্টি খাইয়ে বেড়াচ্ছে ।

জানো পথিক! আমার বাবা আমাকে কেনো এতো কষ্ট করে পড়ালেখা করাচ্ছে ? চাকরি করবো । সমাজে আমার একটা ভালো জায়গা হবে । বাবা মা বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ! আমি নাকি অনেক বড় হবো ! আমাকে দেখে এখন আমাদের পাড়ার ছোটো ছোটোরাও লেগে গিয়েছে পড়াশুনায় । প্রাইমারি থেকেই এই কোচিং সেই কোচিং ! নিশ্চয় তারা একদিন আমাকে কেটে ফেলবে । বুঝলেন তো এখন সবাই পড়ালেখা করে অর্থের জন্য, সম্মানের জন্য । শিক্ষিত হয় কিন্তু জ্ঞানী হয়না । সমাজের অন্যায় অত্যাচার তাদের চোখে পড়েনা । প্যান্ট কোর্ট পড়া মাষ্টার্সবাবু সুদ-ঘুষখোর শশুড়ের মেয়েকেই বিয়ে করে । অথচ এই সুদ ঘুষখোরের জন্যই যে রুনুঝুনুদের বাবা মা গলায় ফাঁস দিয়েছে, তা আর বিয়ের দিন চোখেই পড়েনা।
আমার বোনটার বিয়ের বয়স হয়েছে । পাত্র অনেক ,তবু খুঁজে পাচ্ছিনা । যৌতুকের টাকা এতো পাবো কী করে? সরকার আইন করলে কী হবে! ভালো পাত্র যে টাকা ছাড়া পাগড়িটা মাথায় দেয়না, তাতো কেবল পাত্রীপক্ষের লোকেরাই ভালো করে জানে । ফেন্সী চাচীর মেয়েটাকে গত তিন বছর আগে বিয়ে দিয়েছিলো । বরতো এই সেই বলে কতো টাকা যে নিলো ।এখনো চাচ্ছে । তারপরেও যদি ছেলে ও ছেলে পক্ষের মন পাওয়া যেতো !

এইতো সেদিনের কথা । ফেলানী গিয়েছিলো পাশের দেশে উঁকি মারতে । বিএসএফ দিলো মেরে । এভাবেই প্রায় প্রতিদিন লাশ হয়ে ফিরে আসে ফেলানীরা ।
জানো দ্রুতগামী পথিক? আজকাল প্রাপ্তবয়স্কের একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলেও ধক্কল সামলাতে হয় অনেক। পছন্দের মূল্য না দিয়ে এ সমাজ ছিঃ ছিঃ করে। ব্যর্থতায় কতো ছেলেমেয়ে যে কেওড়াতলার রশিতে ঝুলে!

সমাজের অসঙ্গতি আর কতো বলবো ! হাঁপিয়ে গেছি । শেষ করা সম্ভব নয় । ও হ্যা , তোমার সময় যে নষ্ট করলাম! কোথায় যেনো ত্বরা করে যাচ্ছিলে? মাঝপথে আমি বাঁধা দিলাম । আসলে আমিও একই পথের পথিক ছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ পথে আর হাটবোনা। রাস্তাটায় অনেক বাঁক। আর পথের শেষে বিশাল আবর্জনার স্তুপ। আচ্ছা রাস্তার এতো বাঁক তোমার চোখে পড়লোনা? নাকি চোখ বন্ধ করে দৌড়াচ্ছো! কী বললে? কালের স্রোত তোমাকে তাড়া করছে? তাই বলে ধ্বংসের পোতাশ্রয়েই নিবে শেষ আশ্রয়! চললাম বস ।আমি যে মহাকাল!

লেখক
ইলিয়াস আহমেদ
১৪.০৬.২০১৪ খ্রিঃ

0 comments:

Post a Comment